একবিংশ শতাব্দির এক সিকি ভাগ পূরণের আগেই বিশ্ব এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখী হলো। করোনাভাইরাসজনিত কোভিড১৯ মহামারির অভিজ্ঞতা। ২০২০ সালে এশিয়ার চীন থেকে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে ইউরোপ- আমেরিকায় এক বছর ধরে তান্ডব চালায় ভাইরাসটি। কয়েক কোটি লোকের সংক্রমণ এবং চল্লিশ লাখেরও বেশি প্রাণ হানির ঘটিনার ৯০% ই উন্নত বিশ্ব বলে খ্যাত ইউরোপ এবং আমেরিকায় ঘটে।
এক বছর ধরে ওসব অঞ্চলে করোনার তান্ডব দেখে দেখে আমাদের এই প্রতিতি জন্মেছিল যে, করোনা এসেছে ইউরোপ – আমেরিকাকে শিক্ষা দিতে। কারণ ওরা অমুসলিম, ওদের পাপ অনেক। তারা সারা বিশ্বে মুসলিমদের উপর দশকের পর দশক ধরে টানা অত্যাচারের স্টীমরোলার চালিয়েছে। ব্যাপক বিধ্বংসী মরনাস্র ব্যবহার করে নিরীহ মানুষের জানমালের সীমাহীন ক্ষতি করেছে। এর বিপরীতে মুসলিম বিশ্ব কোনরূপ প্রতিরোধ কিংবা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। কার্যত সবল শত্রুর উপর প্রকৃতি নির্ভর প্রতিশোধ প্রবণতায় দুর্বলদের শান্তনা এরূপই হয়।
বঙ্গীয় মুসলিম মানসে এমন প্রতিক্রিয়ার বাড়তি কারণ করোনাকে নিয়ে কিছু ইসলামী বক্তার অবৈজ্ঞানিক এবং অধার্মিক বিশ্লষণাত্মক বয়ান। একজনের স্বপ্নে দেখা বিবরণকে পূর্ণদৈর্ঘ কাহিনিতে রূপ দিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত হয় যে, করোনা ইসলাম এবং মুসলমানদের শত্রুদের শায়েস্তা করতেই পৃথিবিতে এসেছে। সে স্বপ্নদ্রষ্টা বাংলাদেশকে তো করোনার সিলেবাস থেকে বাদ দিয়েই দিয়েছেন । সুতরাং, আরকি? খুশিতে বগলদাবা ওয়েজ ভক্তদের।
আরেকজন বিখ্যাত বক্তা তো মুসলমানদের ওজু নামাজের প্রেসক্রিপশন দিয়ে বলে দিয়েছেন এরপরও যদি করোনা হয় তাহলে কৈফিয়ত তার কাছ থেকে নিতে। আবার বলেন, মুসলমানদের করোনা হলে কোরানই মিথ্যা হয়ে যাবে (নাউজুবিল্লাহ) । এসব অর্বাচীন কথাবার্তায় অন্ধভক্ত মুসলমানরা আস্থা রাখলেও বোধ বিবেচনাসম্পন্নরা পড়েন বিপাকে। আরে বলে কি? এমনটা কি আল্লহর নেজাম? নিজেদের দুর্দশার জন্য যেখানে নিজেরাই দায়ী সেখানে অথর্ব, অযোগ্য এবং অপদার্থ মুসলিমদের রক্ষায় ভাইরাস কেন পাঠাবেন সেটি একবারও বিবেচনায় নেয়নি কেউ। আর ইসলামের সমালোচকরা তো ইসলামিক স্কলারদের এমন বালখিল্যতায় নতুন সমালোচনার তাজা উপাদান পেয়ে যান।
অবশ্য শুধু কিছু আলেমই যে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন তা কিন্তু নয়। কয়েকজন ডাক্তারও কম মশকরা করেননি। একজন ডাক্তার তো প্লেকার্ডের লেখা দেখিয়ে দেখিয়ে সোশাল মিডিয়ায় জ্ঞান দিতেন করোনা সম্পর্কে । বলতেন করোনা শীতপ্রধান দেশের রোগ। বাংলাদেশের তাপমাত্রায় সেটি টিকতেই পারবে না। গরম এলেই বাংলাদেশের বাজিমাত। আর তাইতো গেল বছরের গরমকালটা শুরু হবার সাথে সাথে আমরাও বেপরোয়া হয়ে পড়ি। স্বাস্থ্যবিধিকে বাই বাই জানিয়ে বাজার, শপিংমল, পর্যটনকেন্দ্রসহ সবকিছু খোলে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আর উৎসবের আমেজে দেশ হয়ে ওঠে মুখর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তখনো বন্ধ থাকার সুযোগে স্বপরিবারে সবাই ছুটে যায় পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে বেড়াতে।
এরপর অবশ্য ধারণা করা হয় শীতের মধ্যেই আসবে দ্বিতীয় ঢেউ। কিন্তু না এসময়টা বেশ নিরাপদেই পার করে বাংলাদেশ। নিরাপদবোধটা এমনই স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল যে, শীতোত্তর ফেব্রুয়ারি মাসে দেশব্যাপী ঘটা করে একদফা পৌরসভা নির্বাচনও হয়। আর পার্শবর্তি দেশ ভারতে চলে বিধানসভার নির্বাচন। এরই মাঝে খবর রটে ভারতে নতুন ধরণের ভাইরাসে সংক্রমণ বাড়ছে হু হু করে। অচীরেই সেটি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট করোনাভাইরাস হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। দৈনিক সংক্রমণের তীব্রতা আর মৃত্যু প্রতিটিতেই রেকর্ড গড়ে ভারতও নাম লেখায় মৃত্যুর দিক দিয়ে আমেরিকা ও ব্রাজিলের পর সর্বোচ্চ তৃতীয় অবস্থানে। দেশের বেকুফ ধার্মিকরা তখনো বেশ ফুরফুরে মেজাজে। রাষ্ট্রীয়ভাবে মুসলিম নীপড়রক হিন্দুত্ববাদী ভারতের উচিৎ শিক্ষা হচ্ছে , এটাই তখনো বদ্ধমূল তাদের মনে। অথচ এরপরের বাঁক যে বাংলাদেশের দিকে ঘুরতে যাচ্ছে তা তারা ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি।
টানা এক বছররেও বেশি সময় ধরে করোন দাবড়িয়েছে সারা বিশ্বে। জীবন ক্ষতির দিক থেকে শীর্ষে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দাবি করা দেশ আমেরিকা। দ্বিতীয় স্থানে আছে ল্যটিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলও। ইউরোপীয় ইউনিয়নভূক্ত দেশগুলোর সামষ্টিক প্রাণহানিও একটি বড় সংখ্যায়। আশা করা হচ্ছিল ঘুরেফিরে ওসব অঞ্চলেও থাকবে ভাইরাসটি। একপর্যায়ে নিষ্ক্রিয়ও হয়তো হয়ে পড়বে। কিন্তু নতুন সংক্রমণের ধার নিয়ে সেটি দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপক বিস্তার ঘটাবে তেমনটি ছিল ধারণাতীত।
ভারতের প্রতিবেশি দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার আশংকা ছিল স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মাঝে শুরু থেকেই। সেলক্ষ্যে কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থার সুপারিশও ছিল তাদের দিক থেকে। কিন্তু তা পুরোপুরি আমলে না নিয়ে আংশিক গ্রহণ করা হয়। ইতিমেধ্যে ঢাকায় নতুনভাবে ব্যাপক সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিকার ও প্রতিরোধকল্পে সংক্রমণপ্রবণ বিশেষ বিশেষ এলাকায় সীমিত আকারে লকডাউন দেয়া হয়। এপ্রিল এবং মে জুড়ে রমজানের শেষের দিকে মার্কেট খোলা রাখা আবার জনচলাচল রোধে আন্তজেলা যানচলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। কিন্তু অপরিণামদর্শি জনস্রোতের নিকট সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। মানুষদের যাদের গ্রামে যাবার তাড়া নানা উপায়ে গ্রামে যায়। ঈদের পর আবার রাজধানীতে ফিরেও আসে। এবার বড় কিছু একটা ঘটবে সে আশংকায় দিনক্ষণ গণনা শুরু হয়।
আশংকা মিথ্যা হয়নি। ঢাকার বাইরে যাতায়াতকারীদের কেউ কেউ ঢাকার করোনা যাতায়াতকৃত এলাকায় ছড়িয়েছেন। আবার সীমান্ত এলাকায় ইতিমধ্যে নীরবে ছড়িয়ে পড়া ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায ফিরে আসেন অনেকে। রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন সীমান্ত জেলা প্রান্তে সংক্রমণের খবর মিলেছিল ধীরলয়েই। পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়ার খবর মিলে খুলনা বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে। ঢাকার বাইরে ঢিলেঢালা লকডাউন দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার প্রাথমিক চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সংক্রমণের ব্যাপকতা এবং মৃত্যুর ভয়াবহতা বেড়ে যাওয়ায় ১ জুলাই থেকে এক সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধ কর্মসূচি ঘোষনা করা হয়। এরপর আরো এক সপ্তাহ বাড়িয়ে ১৪ জুলাই পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে।
কথায় বলে, বঙ্গমনে রঙ্গ বেশি। তাই ততক্ষণ তাদের হুঁশ হয় না যতক্ষণ না বিপদ আপন ঘাড়ে চাপে। মৃ্ত্যুর সংখ্যা কম দেখে আগে মন ভরেনি। তাই অবহেলা, উপহাস আর মনগড়া ব্যাখ্যায় করোনাকে নিয়ে এক প্রকার লুকোচুরি খেলায় মেতিছিল দেশ। এখন সংক্রমণ ও মৃত্যৃ হারের ঝড়ো উর্ধগতিতেও মনে হয় না আমাদের যথেষ্ট হুঁশ হয়েছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে যখন আমাদের করার ছিল যথাযথভাবে তা তখন করিনি। আর এখন পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে আমাদের করারও শেষ । পর্যাপ্ত প্রতিষেধক টীকা নেই । হাসপাতালে বেড খালি নেই। এখন সময়টা বুঝি করোনারই। যা করে করোনাই করবে। আল্লাহ তুমি রক্ষা করো্।
পুনশ্চ: পৃথিবির কোনো জাতিকে আল্লাহ কোন গজব দিয়ে একেবারে ধ্বংস করে দিবেন না, এটা জানার পরও যেসব আলেম করোনাকে অমুসলিমদের শায়েস্তাকারী সৈনিক হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন কিংবা আনভ্যারিফাইড কোন মামুন মারুফের স্বপ্নের কাহিনী উপস্থাপন করে শ্রোতা মাতিয়েছেন বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের বক্তব্য জানা খুবই জরুরী। বক্তব্য জানা জরুরী সেসব ডাক্তারদেরও যারা বলেছিলেন করোনা সাধারণ জ্বর সর্দির মতই একটি রোগ। গরম এলেই চরম বিপদে পড়ে পালাবে সে। অথচ এ গরমেই সে বেপরো ভাব দেখাচ্ছে! জানেন কি সেই ডাক্তার সাহেব?
লেখক: কবি, কলামিস্ট ও ব্যাংকার